ঈশ্বরের সেবক থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - খ্রিষ্টান ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

দশম অধ্যায়

ঈশ্বরের সেবক থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী

এই অধ্যায়ে আমরা একজন মহৎ ব্যক্তির জীবনী নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি। শুরুতে বলা উচিত যে, মহৎ ব্যক্তিরা আমাদের মতো মানুষ ছিলেন। তাঁদের অনেকেই আবার সাধারণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তবে পিতা-মাতা ও গুরুজনদের জীবনাদর্শ ও শিক্ষা-দীক্ষায় বড় হয়ে, সাধনা বলে নিজের মন-মনন ও মেধাকে বিকশিত করে তাঁদের অনেকে মানব-পরিবারের জন্য উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে ইতিহাসে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে উঠেছেন। এ জন্যই বলা হয় : জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো। অর্থাৎ মানুষ তার জন্মের জন্য দায়ী নয়, কিন্তু কর্মের জন্য অবশ্যই দায়ী। কর্মগুণেই মানুষ ইতিহাসে খ্যাতিমান হয়ে উঠেন। এরূপ মহৎ ব্যক্তির জীবনী পাঠ করে আমরাও অনুপ্রাণিত হই এবং নিজেদের মেধা ও গুণাবলি বিকাশে যত্নবান হই। তোমরা হয়তো ইতিহাসের খ্যাতনামা বীর, রাজা-বাদশা, কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিক, লেখক, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারক, এমনকি সাধু-সাব্বির নাম শুনেছ এবং তাদের জীবনী পাঠ করে তোমাদের মনে সুন্দর স্বপ্ন জেগেছে। আসলে ছাত্র জীবন তো সেরূপ স্বপ্ন দেখার ও সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সাধনা করারই সময় তোমাদের সকল শুভাকাঙ্ক্ষী ও গুরুজনও তোমাদের কাছে তা-ই প্রত্যাশা করেন। এসো আমরা এখন এমন একজন ব্যক্তি সম্বন্ধে জানতে চেষ্টা করি যিনি একটি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও সাধনাবলে তাঁর মেধার বিকাশ ঘটিয়ে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন, আবার একই সময়ে অধ্যাত্ম সাধনায় উৎকর্ষ লাভ করে বাংলাদেশ মণ্ডলীর ইতিহাসে একজন পবিত্র ব্যক্তি হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। সেই ব্যক্তির নাম থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী

এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা

আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর শৈশব জীবন বর্ণনা করতে পারব;

• আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর যাজকীয় জীবন বর্ণনা দিতে পারব:

বিশপ ও আর্চবিশপ হিসেবে বাংলাদেশ মণ্ডলীর ইতিহাসে গাঙ্গুলীর ভূমিকা বর্ণনা করতে পারব;

• শিক্ষা বিস্তারে ও যুব গঠনে তাঁর অবদান বর্ণনা করতে পারব;

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে পারব;

• মানব পরিবারের কল্যাণকাজে আগ্রহী হব।

 

 

 

ঈশ্বরের সেবক থিওটোনিয়াম অমল গাঙ্গুলী।

পাঠ ১ আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর জন্ম ও শৈশব

বিংশ শতকের শুরুর দিকে বাংলাদেশ খ্রিষ্টমতলীর ভাগ্যাকাশে এক নতুন নক্ষত্রের উদয় হয়। ঢাকা জেলার অন্তর্গত নবাবগঞ্জ থানার অধীন হাসনাবাদ গ্রামে একটি শিশুর জন্য হয়। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি নিকোলাস গমেজ ও রোমানা গমেজের পরিবারে তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান একটি ছেলের জন্ম হয়। জন্মের আট দিন পর ২৬শে ফেব্রুয়ারি তারিখে তাঁকে দীক্ষাস্নান সংস্কার দেওয়া হয় হাসনাবাদ জপমালা রাণীর গির্জায় এবং তাঁর নাম রাখা হয় থিওটোনিয়াস, ডাক নাম অমল। থিওটোনিয়াস অমলসহ নিকোলাস ও রোমানার তিন ছেলের মধ্যে অমল ছিল দ্বিতীয় বড় ছেলের নাম জেভিয়ার ও ছোট ছেলের নাম বিমল। পরবর্তীতে পারিবারিক নাম পরিবর্তন করে তারা গাঙ্গুলী নাম গ্রহণ করেন।

অমলের বাবা-মা আদর করে তার থিওটোনিয়াস নামটিকে সংক্ষিপ্ত করে 'ঘেঁটন' বলে ডাকতেন। আবার তার ঠাকুরমা বালক বয়সে থিওটোনিয়াসের বুদ্ধির প্রখরতা দেখে আদরের সুরে নাতিকে ডাকতেন 'টেটন' বলে। দিনে দিনে ঠাকুরমার দেওয়া আদরের নামটির সার্থকতা প্রকাশ পেতে থাকে থিওটোনিয়াসের বুদ্ধিমত্তায়। শৈশবেই সবক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিনম্র আচরণে ও পড়াশোনায় তার সাফল্য দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়।

নিকোলাস ও রোমানা তাঁদের তিনটি ছেলে সন্তান নিয়ে সুখেই দিন কাটাতেন। নিকোলাস চাকুরি করতেন কলকাতায়, আর তাঁর স্ত্রী রোমানা তিন ছেলে সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে হাসনাবাদ গ্রামের বাড়িতে সুখে-শান্তিতেই ছিলেন। মা রোমানা সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যাপারে খুবই যত্নবান ছিলেন। স্কুলের শিক্ষার পাশাপাশি তিনি সন্তানদের ধর্মীয়, নৈতিক ও মানবিক গঠনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তারা তিন ভাই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং পিতা-মাতা ও গুরুজনদের প্রতি বাধ্য। তাঁরা সবাই তাদের বাড়ির অদূরে হলিক্রস ব্রাদারের দ্বারা পরিচালিত বান্দুরা হলিক্রস হাইস্কুলে লেখাপড়া করেছেন। মা রোমানা নিজে প্রতিদিন পবিত্র খ্রিষ্টযোগে যোগদান করতেন এবং ছেলেদেরও খ্রিষ্টযোগে যোগ দিতে উৎসাহ দিতেন। তারা সবাই মিলে পারিবারিক জপমালা প্রার্থনাও করতেন নিয়মিতভাবে। থিওটোনিয়াস হাসনাবাদ গির্জায় হস্তার্পণ সংস্কার গ্রহণ করেন ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুন তারিখে। এভাবে সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশে গুরুজনদের আদর যত্ন ও ভালোবাসা পেয়ে তিন ভাই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। বড় ভাই জেভিয়ার বান্দুরা হলিক্রস হাইস্কুলে পড়াশোনা শেষ করে কলকাতায় তাঁর বাবার কাছে চলে যান। সেখানে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি নিয়ে কলকাতায় প্র্যাকটিস শুরু করেন। ছোট ভাই বিমল বান্দুরা হলিক্রস স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করে কলেজে পড়ার জন্য ঢাকায় চলে যান ।

কাজ : তোমার এলাকার এমন একটি আদর্শ পরিবারের বিষয়ে লেখ, যে পরিবার থেকে অন্তত একজন সন্তান ঈশ্বরের ডাকে সাড়া দিয়ে মণ্ডলীতে সেবা কাজ করছেন।

পাঠ ২ : সেমিনারীতে প্রবেশ ও যাজক পদে অভিষেক

প্রতিটি আদর্শ পরিবারে মা-বাবা সন্তানদের আদর-যত্ন দিয়ে লালনপালন করেন এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। নিকোলাস ও রোমানাও একইভাবে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁদের তিনটি পুত্রসন্তানকে ঘিরে। তবে অমলকে নিয়ে তাঁদের স্বপ্ন ছিল একটু ভিন্নতর। সে যে প্রতিদিন খ্রিষ্টযাগে যোগদান করতো এবং বেদীসেবকের কাজ করতে আগ্রহী ছিল তা দেখে তাঁরা খুব আনন্দ পেতেন। কেননা নিয়মিতভাবে খ্রিষ্টযাগে যোগদান করে যাজকের সান্নিধ্য পেলে তাদের কিশোর সন্তানের মধ্যে যাজক হবার ইচ্ছা জাগতে পারে- এই ছিল তাঁদের মনের একান্ত প্রত্যাশা। তাই অমলকে নিয়ে তাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং কল্পনা করেছিলেন যে, তাঁদের এই সন্তানটি একদিন যাজক হিসেবে অভিষিক্ত হবে এবং মণ্ডলীর জন্য কাজ করবে। অচিরেই দেখা গেল অমলের ঝোঁক অনেকটা সেদিকেই।

হাসনাবাদ মিশন প্রাইমারি স্কুল থেকে তৃতীয় শ্রেণি পাস করে অমল বান্দুরা হলিক্রস হাইস্কুলে ভর্তি হন। অত্যন্ত মেধাবী ও তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির অধিকারী অমল বান্দুরা স্কুলে প্রতি শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করতেন। সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বান্দুরা ক্ষুদ্রপুষ্প সাধ্বী তেরেজা সেমিনারীতে প্রবেশ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু সেমিনারীতে প্রবেশ করতে হলে স্থানীয় পালক- পুরোহিতের বিশেষ সুপারিশের প্রয়োজন হয়। হাসনাবাদ পবিত্র জপমালা রাণী গির্জার পালক- পুরোহিত জানতেন যে, অমল নিয়মিত খ্রিষ্টযাগে যোগদান করে এবং বেদীসেবকের দায়িত্ব ফর্মা-১৩, খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা-অষ্টম শ্রেণি

খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

পালন করে তাই তিনি খুশি হয়ে অমলের সেমিনারীতে প্রবেশ করার জন্য জোর সুপারিশ করলেন। এভাবে মা-বাবার অনুমতি ও আশির্বাদ এবং পালক-পুরোহিতের সুপারিশ নিয়ে অমল ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ক্ষুদ্রপুষ্প সেমিনারীতে যোগদান করেন। ক্ষুদ্রপুষ্পে সেমিনারী ও হলিক্রস হাইস্কুল পাশাপাশি অবস্থিত। স্কুলটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন হলিক্রস ব্রাদারগণ এবং সেমিনারীর পরিচালক ছিলেন হলিক্রস যাজকগণ

সেমিনারীর ও স্কুলের ছাত্র হিসেবে অমলের শিক্ষা ও যাজকীয় জীবনে গঠন অত্যন্ত সুন্দরভাবে চলতে লাগলো । সবার নিকট তিনি মেধাবী ও ভাল ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি স্কুলে ও সেমিনারীতে নাটকে অভিনয়, গান গাওয়া, ফুটবল ও হ্যান্ডবল খেলা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করতেন এবং এগুলোতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। এসব ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব এবং তাঁর অমায়িক চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের জন্য তিনি সবার নিকট সুপরিচিত ছিলেন। সেমিনারীর পরিচালক ও স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য ব্রাদারগণসহ সকল শিক্ষকও তাঁর মেধা, মননশীলতা ও সুন্দর আচরণে মুগ্ধ ছিলেন। সেমিনারীর নিয়মকানুন পালনেও তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন । তাঁর সততা, নম্রতা, বিনয় ও হাসিখুশি ভাব দেখে স্কুলের সহপাঠী ও অন্যান্য ছাত্ররা তাকে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বলেই মনে করতো। সুনাম ও কৃতিত্বের সাথে পড়াশোনা করে অমল বান্দুরা হলিক্রস হাইস্কুল থেকে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন (বর্তমান এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

তৎকালীন পূর্ববঙ্গে বান্দুরা ক্ষুদ্রপুষ্প সেমিনারী ছাড়া যাজকীয় জীবনের প্রস্তুতিপর্বে পড়াশোনার জন্য অন্য কোন উচ্চতর সেমিনারী ছিল না। সুতরাং মণ্ডলী কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে থিওটোনিয়াস অমলকে যাজকীয় অভিষেকের প্রস্তুতিপর্বে পড়াশোনা করার উদ্দেশ্যে উত্তর ভারতের রাঁচী শহরে সেন্ট আলবার্ট সেমিনারীতে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি দু'বছর জুনিওরেট কোর্সে পড়াশোনা করেন। এবং পরবর্তীতে উচ্চতর সেমিনারীতে ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। অতঃপর ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাস পর্যন্ত সেখানে তিনি ঐশতত্ত্ব পড়াশুনা করেন। সেখানেও বরাবরই তিনি সকলের নিকট অত্যন্ত মেধাবী, বিনয়ী, নম্র ঈশ্বরভক্ত ও প্রার্থনাশীল মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর চরিত্র ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই তাঁকে তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে মনে করতো। দীর্ঘ ছয় বছর রাঁচীর সেন্ট আলবার্ট সেমিনারীতে পড়াশোনা করার পর ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুন তারিখে মাত্র ২৬ বছর বয়সে থিওটোনিয়াস গাঙ্গুলী যাজকপদে অভিষিক্ত হন

অভিষেক লাভ করার পর ফাদার থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী ঢাকায় ফিরে আসেন। তাঁর নিজ ধর্মপল্লি হাসনাবাদে তাঁকে অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। অতঃপর তাকে বান্দুরা ক্ষুদ্রপুষ্প সেমিনারীর সহকারী পরিচালক নিয়োগ করা হয় এবং তাকে সেমিনারীয়ানদের ধর্মীয় বিষয় শিক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি অতি আনন্দের সাথে সেই দায়িত্ব গ্রহণ ও পালন করেন খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

করা হয় বলে তাকে বলে প্রেরণকর্ম। ফাদার পাঙ্গুলী যেসব প্রেরণকর্মে নিবেদিত ছিলেন তার কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলো:

ক) শিক্ষক হিসাবে ফাদার গাঙ্গুলী : আমেরিকায় পড়াশোনা শেষ করে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ফাদার গাঙ্গুলীকে পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত সেন্ট গ্রেগরী কলেজে অধ্যাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২৬শে অক্টোবর সন্ধ্যায় কলেজ প্রাঙ্গণে তাঁকে সাড়ঘর অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। এরপর থেকেই তিনি কলেজে যুক্তিবিদ্যা পড়াতে শুরু করেন।

শিক্ষকতার কাজে ফাদার গাঙ্গুলী অনেক আনন্দ পেতেন। ছাত্রদের তিনি আন্তরিক ভালবাসতেন। তিনি সব সময় পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে আসতেন এবং পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু অত্যন্ত সুন্দরভাবে ছাত্রদের বুঝিয়ে দিতেন। তাঁর ছাত্রদের প্রতি ছিল অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদবোধ। প্রত্যেক ছাত্রের নাম তাঁর মুখস্থ ছিল, সবাইকে তিনি নাম ধরেই ডাকতেন। এতে ছাত্ররা তাঁকে অত্যন্ত আপন ভাবতো এবং তাঁকে অনেক শ্রদ্ধা করতো। শিক্ষকতার পাশাপাশি ফাদার গাঙ্গুলী ছাত্রদের জন্য বিচিত্র ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমের আয়োজন করতেন। ছাত্রদের জ্ঞানচর্চা যেন শুধু পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে সেই জন্য তিনি সৃজনশীল অনেক কর্মকাণ্ডে ছাত্রদের জড়িত করতেন। তাঁর উদ্যোগে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ আগষ্ট আর্চবিশপ গ্রেগারের প্রতিপালক সাধু লরেন্স-এর পার্বণ উপলক্ষে সেন্ট গ্রেগরী কলেজের ছাত্ররা একটি নাটিকা মঞ্চস্থ করে।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট গ্রেগরীজ কলেজটি লক্ষ্মীবাজার থেকে ঢাকার মতিঝিলে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে কলেজের নতুন ভবন নির্মাণের কাজে ফাদার গাঙ্গুলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। নতুন স্থানে এসে কলেজটির নাম পরিবর্তন করে নটর ডেম কলেজ রাখা হয়। এখানে ফাদার রিচার্ড টিম, সিএসসি বিভিন্ন কাজে, বিশেষ করে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ফাদার গাঙ্গুলীকে সাহায্য দিতেন। বিভিন্ন কাজে ফাদার গাঙ্গুলীর আগ্রহ ও দক্ষতা দেখে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর উপর কলেজের বেশ কিছু দায়িত্ব ছেড়ে দেন। কলেজে সংরক্ষিত রেকর্ড অনুসারে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষ নাগাদ তিনি কলেজে যেসব দায়িত্ব পালন করছিলেন তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো : (ক) শিক্ষা পরিচালক, (খ) ধর্মশিক্ষা-সংক্রান্ত পরিচালক, (গ) মারীয়ার সেনাসংঘের আধ্যাত্মিক পরিচালক এবং বাংলাভাষায় প্রকাশিত বুলেটিন 'মুকুর এর সম্পাদক ও প্রকাশক, এবং (ঘ) হলিক্রস ফাদারদের হাউস কাউন্সিলের সদস্য। তাছাড়া, এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত ম্যাট্রিকুলেশন ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় লাতিন ভাষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের দায়িত্বও তিনি পালন করেন

কলেজের উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ হিসাবে ফাদার গাঙ্গুলী

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ১ নভেম্বর তারিখে ফাদার গাঙ্গুলীকে নটর ডেম কলেজের অস্থায়ী উপাধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়। পাশাপাশি তাঁকে কলেজে কর্মরত সিএসসি ফাদারের সহকারী সুপিরিয়রের দায়িত্ব এবং ঈশ্বরের সেবক থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী

কলেজে প্রধান নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তী বছর তাঁকে কলেজের “হার্ভেস্ট” নামক একটি ম্যাগাজিন প্রকাশনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এসব দায়িত্ব তিনি নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন এবং তাঁর মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে স্থায়ীভাবে কলেজের উপাধ্যক্ষ নিয়োগ করা হয়। অতঃপর ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল তাঁকে অস্থায়ীভাবে এবং ৩০ এপ্রিল স্থায়ীভাবে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফাদার গাঙ্গুলীই হলেন স্বনামধন্য নটর ডেম কলেজের প্রথম দেশীয় অধ্যক্ষ

পালক হিসেবে ফাদার গাঙ্গুলী

নটর ডেম কলেজে সাপ্তাহিক ছুটি ছিল দু'দিন শনিবার ও রবিবার। কলেজের রুটিনমাফিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে এবং ছুটির দিনে ফাদার গাঙ্গুলীসহ কলেজে কর্মরত অন্যান্য ফাদারগণ মণ্ডলীর বিভিন্ন পালকীয় কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখতেন। বিভিন্ন ধর্মপল্লিতে পালক-পুরোহিতদের পালকীয় কাজে সাহায্য দিতেন। বড়দিন বা ইষ্টারের আগে স্থানীয় ধর্মপল্লিতে পাপ স্বীকার সংস্কার প্রদান, স্থানীয় জনগণের জন্য এবং ব্রতধারীদের, ক্যাটেখিষ্ট ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য নির্জনধ্যান ও সেমিনার পরিচালনা, ইত্যাদি কাজেও সাহায্য দিতেন। ফাদার গাঙ্গুলী এসব কাজে যেমন পারদর্শী ছিলেন, তেমনি তাঁর বিজ্ঞ উপস্থাপনার জন্য সমধিক জনপ্রিয় ছিলেন। আজকালকার ন্যায় সে যুগে রাস্তাঘাট তেমন ছিল না, অধিকাংশ সময় পায়ে হেঁটে, না হয় ঘোড়ায় চড়ে বা সাইকেলে যাতায়াত করতে হতো। অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হওয়া সত্ত্বেও ফাদার গাঙ্গুলী আনন্দ সহকারে গ্রামাঞ্চলে গিয়ে এসব পালকীয় কাজ করতেন।

যুবগঠন কাজে ফাদার গাঙ্গুলীর অবদান :

ফাদার গাঙ্গুলী পালকীয় কাজে আনন্দ পেতেন, তাই এসব কাজের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারতেন। নটর ডেম কলেজের ছাত্রদেরকে শ্রেণিকক্ষে পড়ানো ছাড়াও সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে তাদের তিনি উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতেন। বিভিন্ন সময়ে নানা সমস্যা সমাধানে কাউন্সেলিং বা পরামর্শ দিয়ে ছাত্র ও তাদের অভিভাবকদের সহায়তা করতেন। যুবক-যুবতীরাই যে সমাজ ও মরুলীর ভবিষ্যৎ এবং সেহেতু তাদের বিশেষ যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন তা তিনি সকলকে বুঝাতে চেষ্টা করতেন ।

ফাদার গাঙ্গুলী ছাত্র ও যুবকদের বুঝাতে চেষ্টা করতেন কীভাবে তাদের নৈতিক চরিত্র মজবুত ও শক্তিশালী করা যায় দুর্ভাগ্যক্রমে যারা সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়তো তাদেরকে সহায়তা করার জন্য তিনি সব সময়ই তাদের পিতামাতা ও অভিভাবকদের সময় দিতেন। তিনি ধৈর্য সহকারে তাদের কথা শুনতেন এবং দিকনির্দেশনা দিতেন। কলেজ হোস্টেলের ছাত্রদের জন্য তিনি নির্জন ধ্যান পরিচালনা করতেন এবং আধ্যাত্মিক বিষয়ের উপর কনফারেন্স বা ধর্মভাষণ দিতেন। যুবকযুবতীদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গঠনকাজে সহায়তা করার জন্য নিজ উদ্যোগে তিনি একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে

খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর রমনা সেন্ট মেরীজ ক্যাবিজ্ঞানে অনুষ্ঠিত ধর্মপ্রদেশীয় পালক- পুরোহিতদের আলোচনা সভার প্রস্তাব আকারে পেশ করেছিলেন। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার বিষয় নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছিল যার ফলে ধর্মপ্রদেশে যুব সংগঠন কার্যক্রমে পতি সঞ্চারিত হয়েছিল।

পাঠ ৫ প্রথমে বিশপ ও পরবর্তীতে আর্চবিশপ পদে পাজুলী

নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র চার দিন পর, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর, পোপ ত্রয়োবিংশ যোহনের প্রেরিত পত্রের মাধ্যমে ফাদার গাঙ্গুলী জানতে পারলেন যে, তাঁকে বিশপ পদের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। খবরটি দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়। একজন বাঙ্গালী এই প্রথম বিশপ পদে মনোনীত হয়েছেন শুনে সর্বত্র আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে শুরু করলো। অবশ্য খবরটি অপ্রত্যাশিত ছিল না। ফাদার পাঙ্গুলীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, অসাধারণ চারিত্রিক গুণাবলী, কর্মক্ষেত্রে ও প্রশাসনিক কাজে দক্ষতা, অমায়িক আচরণ, সুগভীর আধ্যাত্মিকতা, পালকীর কাজে আগ্রহ-উদ্দীপনা ইত্যাদি লক্ষ্য করে অনেকেই অনুমান করেছিল যে, ফাদার গাঙ্গুলীর উপর মঙ্গীর আরও দায়িত্ব আসতে পারে। সুতরাং যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে দেখে সবাই ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানালো।

ফাদার গাঙ্গুলীর বিশপ পদে মনোনীত হওয়ার শুভ বার্তাটি রোমের অবজারভাতোরে রোমানো-তে এবং পাকিস্তান অভজারভার এ প্রকাশিত হলো। সেখানে আরও জানানো হলো যে, রোম থেকে কার্ডিনাল আগাজিনিয়ান স্বয়ং ঢাকায় এসে অক্টোবরের ৭ তারিখে থিওটোনিয়াস গাঙ্গুলীকে বিশপ পদে অভিষিক্ত করবেন। অভিষেকের দিন রমনা ক্যাথিড্রালে দেশ-বিদেশের অসংখ্য খ্রিস্টভক্ত, যাজক, ব্রাদার, সিস্টার ও অন্যান্য অতিবিদের সমাগম হলো। সাড়ম্বরে সম্পন্ন হলো বিশপীয় অভিষেক অনুষ্ঠাन

বাংলাদেশের প্রথম বাঙালি বিশপ পানী

ঈশ্বরের সেবক থিওটোনিয়াস অমল পাঙ্গুলী।

বাংলাদেশের প্রথম বাঙ্গালি বিশপ গাঙ্গুলী

ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের সকল ধর্মপল্লি এবং নটর ডেম কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নব অভিষিক্ত গাঙ্গুলীকে অভ্যর্থনা জানানো হলো। অতঃপর তিনি ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের সহকারী বিশপ হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে শুরু করলেন। এ সময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল ইত্যাদি এলাকার মান্দিদের উপর নানা রকম অত্যাচার শুরু হয়। এর প্রতিবাদ জানিয়ে আর্চবিশপ লরেন্স প্রেণার, সিএসসি। পাকিস্তান সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে পাকিস্তান সরকার আর্চবিশপ গ্রেগারের ভিসা নবায়ন বন্ধ করে দেন এবং ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে তাঁকে পাকিস্তান থেকে চলে যেতে বাধ্য করেন।

আর্চবিশপ পদে গাঙ্গুলী

আর্চবিশপ গ্রেনার পাকিস্তান থেকে চলে গেলেও তিনি আশাবাদী ছিলেন যে পাকিস্তান সরকার তাঁকে ফিরে আসার সুযোগ দিবেন। তাই পোপ মহোদয় তাঁকে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন ঢাকার আর্চবিশপের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ না করেন। ইত্যবসরে উত্তরসূরী আর্চবিশপ গাঙ্গুলী ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। অবশেষে আর্চবিশপ গ্রেনারের আর এদেশে ফেরার সম্ভাবনা না থাকাতে তিনি ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩ নভেম্বর পোপ মহোদয়ের নিকট তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দেন। সেদিন থেকেই আর্চবিশপ গাঙ্গুলী ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের স্থায়ী আর্চবিশপ পদে বহাল হন। তবে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জানুয়ারি তারিখে। তাঁর দক্ষ পরিচালনায় ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশে স্থানীয় মণ্ডলীর নতুন জাগরণ ও যাত্রা শুরু হলো । সেই জাগরণ নানাভাবে প্রকাশ পেতে শুরু করলো। স্থানীয় আহ্বানের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে লাগলো তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে স্থানীয় মণ্ডলী অনেক দিক দিয়েই এগিয়ে গেল ।

এদেশে বহু বছর ধরে মণ্ডলীর পরিচালনায় ছিলেন বিদেশী মিশনারীগণ। এখানকার মণ্ডলী প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু দ্বিতীয় ভাভিকান মহাসভার পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে দেশ স্বাধীন হবার পর স্থানীয় মণ্ডলীর প্রত্যাশা ও প্রয়োজন অনেক বেশি অনুভূত হতে শুরু করে। এর প্রেক্ষাপটেই স্থানীয় মণ্ডলীর অগ্রযাত্রায় স্থানীয় আর্চবিশপের ভূমিকা অধিকতর চ্যালেঞ্জপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি অতিশয় সহজ সরল ও নরম স্বভাবের মানুষ ছিলেন বলে কাউকে তিনি আঘাত দিতে পারতেন না। কারো সাথে রাগও করতে পারতেন না। পক্ষান্তরে তিনি এমনকি বিরূপ সমালোচনাকেও নীরবে সহ্য করতেন। এই কারণে অনেকে তাঁকে দুর্বল মনে করতেন এবং দলাদলি সৃষ্টি করে তাঁর মনে কষ্ট দিতেন।

খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

পাঠ ৬: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর ভূমিকা

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকই গর্ববোধ করে। যুক্তি যুদ্ধের সময়, জাতির সঙ্কটকালে আর্চবিশপ গাঙ্গুলী অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাস ব্যাপী তুমুল যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে সত্য, কিন্তু এর জন্য জাতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। নিরস্ত্র লক্ষ লক্ষ বাঙালী পাকিস্তান হানাদারবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে, আবার পাকিস্তান হানাদারবাহিনীর অত্যাচারের শিকার হয়ে, সহায় সম্বল হারিয়ে পথের ভিখারী হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ ও অমানুষিক নির্যাতনের ফলে অনেকেই শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এরূপ সঙ্কটময় মুহূর্তে আর্চবিশপ গাঙ্গুলী বাংলাদেশের সকল যাজক, ব্রাদার ও সিস্টারদের একটি জরুরি পরিপত্র পাঠিয়ে নির্দেশ দিলেন যেন সবাই সাধ্যমতো শরণার্থী বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং তাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন।

আর্চবিশপ গাঙ্গুলী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তান সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের উপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ করার আবেদন জানানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাতে উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। পোপ ৬ষ্ঠ পলের নির্দেশ অনুযায়ী আর্চবিশপ গাঙ্গুলী পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত জঘন্য অপরাধের জন্য সকলকে অনুতাপ ও প্রায়শ্চিত্ত করার আহ্বান জানিয়ে সকল ধর্মপল্লির যাজকদের নিকট পত্র দিয়েছিলেন। আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর নির্দেশ অনুযায়ী অনেক মিশনে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল, আহতদের জন্য চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা হয়েছিল।

পঞ্চম বিশ্বশান্তি দিবস উপলক্ষে আর্চবিশপ গাঙ্গুলী কর্তৃক ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি মণ্ডলীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যৌথভাবে সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে দেশের বেশ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ও সেনাকর্মকর্তা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আর এন মিরাসহ বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে আর্চবিশপ থিওটোনিয়াস গাঙ্গুলী তাদের সংবর্ধনা প্রদান করেন এবং পঞ্চম বিশ্বশান্তি দিবসকে কেন্দ্র করে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। উক্ত লিখিত বক্তব্যে আর্চবিশপ গাঙ্গুলী বলেন, “গভীর সম্মান ও কৃতজ্ঞতাভরা অন্তরে আমি ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং আমাদের মুক্তিবাহিনীর জওয়ানদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। কারণ আপনারা আমাদের বাংলাদেশে স্বস্তি ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই আজ আনন্দে আপ্লুত হয়ে আপনাদেরকে আমরা আমাদের মাঝে অতিথি হিসেবে বরণ করে নিচ্ছি; যাঁরা আমাদের দেশে ন্যায্যতা ও শান্তি আনয়নের জন্য অকাতরে জীবন দান করেছেন আমরা কী করে আজ তাঁদের ভুলে থাকি? আমাদের সবিনয় প্রার্থনা, কৃপাময় পরমেশ্বর তাঁদেরকে যোগ্য পুরস্কারে ভূষিত করুন। "

 

ঈশ্বরের সেবক থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী

পাঠ ৭: অনন্তের পথে যাত্রা

প্রভুর বিনম্র সেবক, নিরলস কর্মী, ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের প্রথম দেশীয় বিশপ ও পরবর্তীতে আর্চবিশপ থিওটোনিয়াস গাঙ্গুলী ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর তারিখে বিকেল আনুমানিক ৪টার দিকে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর্চবিশপ হাউসে সে সময় উপস্থিত ছিলেন সিস্টার প্রজ্ঞা, এসএমআরএ এবং ফাদার চার্লস গিলেসপি, সিএসসি। আর্চবিশপ গাঙ্গুলী বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করাতে সিস্টার প্রজ্ঞা ও ফাদার সিলেসপি তাঁকে গাড়িতে তুলে মগবাজার ডাক্তার জামানের ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা দেন। সেখানে পৌঁছে গাড়ি থেকে তাঁকে নামানোর আগেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কর্তব্যরত ডাক্তার পরীক্ষা করে জানান আর্চবিশপ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর মৃত্যুতে সারা দেশের খ্রিষ্টান সমাজের উপর শোকের ছায়া নেমে আসে। অবিলম্বে সকল ধর্মপ্রদেশের বিশপগণ ঢাকায় আসতে শুরু করেন। অগণিত ভক্তসাধারণও তাদের প্রিয় আর্চবিশপকে চিরবিদায় জানানোর আগে এক নজর দেখার জন্য ঢাকায় এসে জড়ো হন । পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর তারিখে শেষকৃত্য মহাখ্রিষ্টযাগ উৎসর্গ করা হয় রমনা ক্যাথিড্রালে। অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেন তৎকালীন খুলনা ধর্মপ্রদেশের বিশপ মাইকেল অতুল ডি'রোজারিও, সিএসসি এবং খ্রিষ্টযাগে ধর্মোপদেশ দিয়েছিলেন ফাদার টমাস জিমারম্যান, সিএসসি। তারপর আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর মরদেহ রমনা আর্চবিশপ ভবনের সামনের চত্বরে সমাধিস্থ করা হয়।

পাঠ ৮ : ঈশ্বরের সেবক আর্চবিশপ গাঙ্গুলী

বাংলাদেশ খ্রিষ্টমণ্ডলীর প্রথম দেশীয় (বাঙালি) বিশপ এবং পরবর্তীতে আর্চবিশপ থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী, সিএসসি পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও ছিলেন শিশুর মতো সরল ও নম্র। পর্বতের উপরে প্রদত্ত উপদেশে যীশু যাদেরকে ধন্য বা সুখী বলেছেন সেরূপ মানুষই ছিলেন তিনি। একজন মানুষ হিসেবে, একজন খ্রিষ্টবিশ্বাসী হিসেবে, একজন যাজক হিসেবে, মণ্ডলীর একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন সফল ও সার্থক । অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে কোনো অহংবোধ ছিল না। পক্ষান্তরে তিনি ছিলেন অন্তরে দীনদরিদ্র, কোমলপ্রাণ, নম্রবিনীত, ন্যায়পরায়ণ, ধার্মিক, দয়ালু, শুদ্ধচিত্ত, বিবেকবান, শাস্তির সাধক ও ধর্মময়তার জন্য ভূষিত মানুষ তিনি ছিলেন সমস্ত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে। তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রিয়। যে কেউ একবার তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছে সে তাঁর বিষয়ে জীবন্ত সাক্ষী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছে।

খ্রিষ্টধর্মের বিশ্বাস ও শিক্ষা অনুসারে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য যার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তাঁকে ধন্য বা সাধু বলে আখ্যা দেওয়া হয়। সেই রীতি অনুযায়ী কাথলিক মণ্ডলী প্রয়াত আর্চবিশপ গাঙ্গুলীকে ধন্য বা সাধু শ্ৰেণীভুক্তকরণের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে তাঁকে “ঈশ্বরের সেবক” সম্মানসূচক উপাধিতে ভূষিত করেছেন। অদূর ভবিষ্যতে তিনি হয়তো সাধুশ্রেণীভুক্ত হবেন। সারা বছর, বিশেষ করে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে শত-সহস্র ভক্ত তাঁর সমাধিস্থলে ভিড় জমান। তাঁরা তাঁর জন্য প্রার্থনা না করে বরং তাঁর কাছেই প্রার্থনা জানান। দিনে দিনে তাঁর প্রতি ভক্তবিশ্বাসীদের শ্রদ্ধা-ভক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের প্রাক্তন আর্চবিশপ পৌলিনুস কস্তা জনগণের অনুরোধে পোপ মহোদয়ের সাধু-সন্ত বিষয়ক সংস্থার কাছে তুলে ধরে প্রয়াত আর্চবিশপ গাঙ্গুলীকে সাধু শ্রেণিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করার আবেদন জানালে রোমের পবিত্র দপ্তর ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর, আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর ২৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে “ঈশ্বরের সেবক” উপাধি প্রদান করেন এদিনে “ঈশ্বরের সেবক আর্চবিশপ গাঙ্গুলী'র ধন্য শ্রেণিভূক্তকরণের উদ্দেশ্যে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় । এই কমিটিকে তাঁর ধন্যশ্রেণিভুক্ত হওয়ার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমাদের প্রার্থনা, ঈশ্বর তাঁর এই বিনম্র ভক্তসাধককে স্বর্গে ও পৃথিবীতে সর্বত্র মহিমান্বিত করুন।

প্রয়াত আর্চবিশপ গাঙ্গুলীর প্রতি বিশেষ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের চিহ্নস্বরূপ ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নাম অনুসারে। যেমন, নটর ডেম কলেজে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ৬- তলা বিশিষ্ট ভবনের নামকরণ করা হয়েছে “গাঙ্গুলী ভবন", ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদপুর সেন্ট যোসেফ স্কুল প্রাঙ্গণে কাথলিক মণ্ডলী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত একমাত্র টিচার্স ট্রেনিং কলেজটির নামকরণ করা হয়েছে “আর্চবিশপ টি,এ, গাঙ্গুলী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ।

Content added || updated By

আরও দেখুন...

Promotion